টাঙ্গাইলে সরকারি পতিত জমিতে সূর্যমুখীর মুচকি হাসি
নিজস্ব প্রতিবেদক :সূর্যমুখীরা কাধে কাধ মিলিয়ে এক যোগে কিশোর বয়স পেরিয়ে সবেমাত্র যৌবনে পা দিয়েছে। প্রতিটি ফুল যৌবন রসে ভরপুর- দিচ্ছে মুচকি হাসি যে কোন সময় মন খুলে হাসিটা প্রশস্ত করবে এই সূর্যমুখীরা। টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা প্রশাসনের সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টায় ইটভাটার পরিত্যক্ত ১০ একর পতিত ভূমিতে সূর্যমুখীর চাষ করে সকলের নজর কেড়েছে গড়েছে দৃষ্টান্ত। একদিকে মাঠজুড়ে ফুলের সৌন্দর্য অন্যদিকে অর্থকরী ফসল উৎপাদনে স্থানীয় পর্যায়ে প্রশংসায় ভাসছেন ইউএনও পারভেজ মল্লিক। দূর-দূরান্ত থেকে উৎসুক জনতা আসছে সূর্যমুখীর ওই বাগান দেখতে। এমন মহতি উদ্যোগের প্রশংসা করছেন দর্শনার্থীরা ।
বিজ্ঞাপন
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের গোপালপুরের ভূয়ারপাড়া এলাকার ১০ একর ভূমি তৎকালীন সরকার ইটভাটা স্থাপনের জন্য অধিগ্রহন করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরও এলাকার আতাব আলী, কালু সরকার সহ আরও কয়েক ব্যক্তি ওই স্থানে ইটভাটা পরিচালনা করেন। লাভবান হতে না পারায় ১৯৭৩ সালের পর ইটভাটা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে ওই ১০ একর ভূমি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। জনসংখ্যার বর্ধিতহারের কারণে স্থানীয় লোকজন ওই ইটভাটার পরিত্যক্ত জমি কেটে ব্যবহৃত সবজি চাষ, গরু-ছাগল চড়ানো, কাঁথা-বালিশ শুকানো ইত্যাদি নানা নানা ব্যক্তিগত কাজে অবহেলিত ভাবে ব্যবহারের উদেশ্য জবরদখল করে নেয়। কেউ কেউ অস্থায়ী বসতবাড়িও নির্মাণ করতে থাকে। কেউ ওই জমি থেকে মাটি কেটে অন্যত্র বিক্রি করেন ।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি জেলা প্রশাসন জবরদখল হওয়া ওই ১০ একর জমি পুনরুদ্ধার করে ১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত হিসেবে নথিভুক্ত করে। উদ্ধার করা ওই ১০ একর ভূমির মধ্যে ৩৫ শতাংশ ভূমিতে স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কার্যালয় স্থাপন করা হয়। বাকি অংশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদী না থাকে’- এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় সূর্যমুখীর চাষ করা হয়। গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজ মল্লিকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ওই ‘সূর্যমুখী চাষ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অবৈধ দখলে থাকা উদ্ধারকৃত জমি চিহ্নিত করে সূর্যমুখী চাষ করা হয়েছে। সূর্যমুখী বাগানের তিনপাশে ইরিবোরো ধানের আবাদ। সব মিলিয়ে চারপাশে নির্মল বাতাসের সঙ্গে সবুজের সমারোহে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ । সূর্যমুখীর প্রতিটি গাছ কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পন করেছে। দু -চারটিতে ফুল পাঁপড়ি মেলছে- অন্যগুলো ২-৩ দিনের মধ্যে হাসি ছড়িয়ে পাপড়ি মেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সূর্যমুখী বাগানের পরিচর্যার কাজে শ্রমিকরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন । গোপালপুর পৌরসভার ভূয়ারপাড়া এলাকার বয়োবৃদ্ধ নুরুল ইসলাম, তুলা মিয়া, হাসমত আলী, গৃহবধূ রাশিদা, জমিলা, রত্না,কাশেম,আরিফ ও দর্শনার্থী জামিল,বিলকিস সহ অনেকেই জানান, জেলা প্রশাসন জবরদখল হওয়া ১০ একর জমি উদ্ধার করেছে এটা নি:সন্দেহে ভালো কাজ ১৮৫৭ সালে সরকার ওইস্থানে ৪২ বিঘা সম্পত্তি অধিগ্রহন করেছিল। গরীব ও অসহায়দের দখলে থাকা জমি উদ্ধার করেছে আরও জমি স্থানীয় প্রভাবশালীদের জবরদখলে রয়েছে। সেগুলোর ও দখল মুক্ত চায় তারা।
বিজ্ঞাপন
তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে ওই জমি পতিত পড়ে ছিল। সরকারি উদ্যোগে পতিত জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ করায় খুব ভালো হয়েছে। দেখতেও খুব সুন্দর লাগছে। অন্য এলাকা থেকেও অনেক মানুষ সূর্যমুখীর এ আবাদ দেখতে আসেন।
বাগানের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আব্বাস আলী জানান, আগে তিনি দিনমুজুরী করতেন। একদিন কাজ করলে অন্যদিন বসে থাকতে হতো। সূর্যমুখীর ক্ষেতে তিনি নিয়মিত কাজ করেন। এতে তার সংসার ভালোভাবেই চলছে।
বিজ্ঞাপন
গোপালপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শামীমা আক্তার জানান, কৃষিমন্ত্রী ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক তেল বীজের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সূর্যমুখীতে সরিষা বা অন্য ফসলের চেয়ে বেশি তেল পাওয়া যায়। এ ফুলের তেল স্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাস করে। ক্যান্সার এবং হৃদরোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া ত্বকের সুরক্ষায় সূর্যমুখী অনেক উপকারী। তিনি জানান, উপজেলা কৃষি অফিস থেকে সার দেওয়া হয়েছে। পতিত ১০ একর জমিতে ৪০ কেজি সূর্যমুখীর বীজ বপন করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেচের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। যারা শ্রমিকের কাজ করছেন তাদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও জানান, দেশের আবহাওয়া সূর্যমুখী চাষের জন্য অনুকূল। দুই হাজার টাকা কেজি বীজ কিনে রোপণ করেছিলেন। তিনি আশা করছেন এখান থেকে প্রায় ১০ টন সূর্যমুখী উৎপাদিত হবে। এক মন সূর্যমুখীর বীজ থেকে ১৭ থেকে ২০ কেজি তেল উৎপন্ন হয়। প্রতি কেজি সূর্যমুখী তেলের দাম এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। সূর্যমুখী চাষের উপকারীতা সম্পর্কে মানুষকে জানাতে পারলে এর চাষ অনেকাংশে বাড়বে।
গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজ মল্লিক জানান, জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দারের পরামর্শে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তিনি মনে করেন- দেশের মধ্যে সূর্যমুখীর এটা সর্ববৃহৎ প্রকল্প। সূর্যমুখী উঠানোর পর ওই জমিতে সয়াবিনের চাষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ প্রকল্প দেখে অনেক কৃষক সূর্যমুখী চাষে উৎসাহ পাবে।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার জানান, সূর্যমুখী থেকে ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এই বাগান থেকে যে পরিমাণ সুর্যমূখীর বীজ উৎপাদন হবে তা টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে দেওয়া হবে।
বিজ্ঞাপন
প্রকাশ, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় এ বছর ২৩০ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ২৪২ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। এবারের সূর্যমুখী উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৬৪ মেট্রিক টন।